ফেসবুকের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। হঠাৎ করে নামিদামি সব ব্র্যান্ড বন্ধ করে দিচ্ছে বিজ্ঞাপন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা বেচে দিচ্ছে শেয়ার। রাতারাতি হাজার কোটি ডলার কমে গেছে ফেসবুকের মূল্য। আর সব কিছুর মূলে আছে পুরনো মানবিক ইস্যু, বর্ণবাদ এবং জাতিগত বিদ্বেষ। আর এর মধ্য দিয়েই কি শুরু হলো ফেসবুকের পতন? ‘স্টপ হেট ফর প্রফিট’ নামের একটি সংগঠনের দাবি, বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো তাদের বুস্ট করা পোস্টের থেকে লাভ করছে ফেসবুক।
ফেসবুকে প্রচুর বর্ণবাদী এবং বিদ্বেষী গ্রুপ আছে, সঙ্গে আছে সেসব মানুষের বিদ্বেষের বাণী প্রচার করার পেজ। শুধু সরাসরি বর্ণবাদী বা ফ্যাসিস্ট পেজ বা গ্রুপ ছাড়াও আছে হলুদ সাংবাদিকতার পেজ, যেগুলো মানুষের মধ্যে ভুয়া সংবাদ ছড়িয়ে দিয়ে বিরোধ সৃষ্টি করার চেষ্টা চালায়। এভাবে এ ধরনের পেজ ও বিজ্ঞাপন ব্যবহার করে বেশ কয়েকবার ফেসবুকের মাধ্যমে শুরু হয়েছে বড়সড় ভুল-বোঝাবুঝি, বেড়েছে বর্ণবাদের প্রকোপ। বিদ্বেষ প্রচারের বিরুদ্ধে ফেসবুকের নীতি থাকলেও সেটি তেমন শক্তপোক্ত নয়, মোটামুটি যা খুশি তা-ই ফেসবুকে আজকাল শুধু প্রকাশ করা যায় তা-ই নয়, সেগুলো ব্যবহারকারীরা চাইলেই বুস্ট করে বিশাল পরিমাণ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাছেও পৌঁছাতে পারছেন। এ অবস্থায় স্টপ হেট ফর প্রফিটের চাপে ৫০০টিরও বেশি বড়সড় ব্র্যান্ড ফেসবুক এবং সেটির ব্যানারে চালিত অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, যেমন—ইনস্টাগ্রামেও বিজ্ঞাপন দেওয়া স্থগিত করেছে। বিজ্ঞাপন বন্ধ করা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে—ইউনিলিভার, কোকাকোলা, স্টারবাক্স থেকে শুরু করে মাইক্রোসফটের মতো বিশাল সব কম্পানি। তাদের সবার দাবি, তাদের ব্র্যান্ড ফেসবুকের মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার মানে তারাও নেমে যাচ্ছে বিদ্বেষীদের কাতারে, যেটা কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। তারা আপাতত এক মাস সময় দিয়েছেন ফেসবুককে, যেন তারা তাদের ‘হেট স্পিচের পলিসি’ ঠিক করে। এরপর তারা আবারও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেবে কি না তা অবশ্য নিশ্চিত করে জানা যায়নি।
বড়সড় সব ব্র্যান্ড বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়ায় ফেসবুকের স্টকে নেমেছে ধস। অনেকেই অশনিসংকেত দেখে দ্রুত বিক্রি করে দিচ্ছেন শেয়ার। ফলে গেল দুই সপ্তাহে ফেসবুকের ৮ শতাংশ মূল্য গেছে কমে, যার মূল্যমান ৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমানে সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ারের মালিক মার্ক জাকারবার্গ নিজে অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকা মূলধন হারিয়েছেন। তার পরও তিনি চিন্তিত নন বলেই জানা গেছে। তাঁর দাবি, ফেসবুক এমন কিছু করেনি যাতে বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে আর ফেসবুক সব সময়ই বিদ্বেষ এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে থাকে। তাঁর মতে, ‘স্টপ হেট ফর প্রফিটের ফেসবুক সম্পর্কে ধারণা প্রায় পুরোটাই ভুল। এর পরও ফেসবুক চেষ্টা করবে আরো সুচারুভাবে বিদ্বেষী পোস্ট, গ্রুপ এবং পেজ ফিল্টার করবার। এরপর ব্র্যান্ডগুলো দ্রুতই ফিরে আসবে এবং ফেসবুক ফিরে যাবে তার নিজ অবস্থানে। হয়তো এটাই ফেসবুকের শেষ নয়। কেননা এর আগেও কেমব্র্রিজ অ্যানালিটিকা এবং যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হাত দেওয়ার কেলেঙ্কারি তারা সহজেই কাটিয়ে উঠেছে। বিদ্বেষী ভিডিও নিয়ে ইউটিউবও এমন অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল মাত্র তিন বছর আগে, বড় বড় সব বিজ্ঞাপনদাতা ব্র্যান্ড তাদের থেকে সরে গিয়েছিল। দ্রুততার সঙ্গে তারা মনিটাইজেশন পলিসি এবং বিদ্বেষী ভিডিওর বিরুদ্ধে পলিসি তৈরি করে ব্র্যান্ডগুলোকে ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিল ইউটিউব। ফেসবুকও চাইলে সেটি করতে পারে, কিন্তু তারা করবে কি না তা নিয়েই আছে সন্দেহ। বর্তমানে কভিড, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের মাঝখানে ফেসবুকের গোঁড়ামি করার সুযোগ একেবারেই নেই। কিন্তু যেহেতু তাদের মূল আয় বড় ব্র্যান্ড নয়, বরং ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের থেকেই হয়ে থাকে, তাই তারা বড় ব্র্যান্ড চলে যাওয়াকে বড় সমস্যা নয় বলেই ধারণা করছে। কিন্তু বড়দের পিছু যে ছোট ব্র্যান্ডরাও নেবে না তার অবশ্য কোনো গ্যারান্টি নেই। অতএব হতেও পারে, এটাই ফেসবুক শেষের শুরু!